ব্যক্তিবাদ ও রক্তমাংসের মানুষ-এর ধারনার নোট : ভূমিকা

আদর্শ পোস্ট ফরম্যাট

[ব্যক্তিবাদ হল আধুনিকতা এবং পুঁজিবাদের অন্যতম দার্শনিক পূর্বধারনা। সেই ব্যক্তিবাদের সমালোচনা তৈরি করার চেষ্টা করা হবে এই নোট-গুলিতে। এই নোট-টিতে সেই সমালোচনার ভূমিকা রইল। ভূমিকাতে আমরা গত দুই শতাব্দীর অন্যতম দুই দার্শনিক ও তাত্ত্বিক-এর (ঊনবিংশ শতকে মার্ক্স, বিংশ শতকে ফুকো) হস্তক্ষেপ অত্যন্ত সংক্ষেপে রাখলাম। ]

ছোটো বেলার খেলনা থাকে অনেক টুকরো। সে গুলি হোক বা বিল্ডিং ব্লক। ডাইনোসর হোক বা পশুপাখী। বা প্লাস্টিকের অ আ ক খ এ বি সি ডি। বাচ্চারা খেলা শুরু করে বহু কিছু দিয়ে। যেগুলোর একের সঙ্গে অন্যের কোনো সম্পর্ক নেই। বাচ্চারা সেই ছাড়া ছাড়া স্বাধীন বস্তুগুলিকে তারপর একের সঙ্গে অন্যকে সম্পর্কিত করে।

আমাদের চারপাশ যেহেতু বস্তুতে ভর্তি, তাই আমরা বস্তুজগৎ বলতে কল্পনা করি — নানা পরস্পরের থেকে স্বাধীন বস্তু। বাচ্চারা যেমন অনায়াসে সেগুলিকে হাত দেয়, সেগুলি নিয়ে খেলা করে, তেমনি আমরাও সেগুলি নিয়ে খেলা করি।

বস্তুজগতের আদলে মানুষদের দেখার অভ্যেস তাই অত্যন্ত মানুষিক। যদিও একেবারে আশেপাশের লোকেদের বস্তু হিসেবে দেখা সম্ভব নয়। সেই জন্য মানুষ নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের কাগজে পড়া বা টিভিতে দেখা অনেক দূরের লোকেদের কথা মনে হয়। আমরা যখন মানুষের সমস্যা নিয়ে ভাবতে বসি, তখন আমাদের একেবারে পাশের লোকেদের কথা মাথায় থাকে না। চিন্তার কায়দাটাই হল — একটু ওপর থেকে দেখা সবকিছুকে, পাখির চোখে। চিন্তার কায়দাটাই হল — একটু বড়ো পরিসরকে চিন্তা করা। যেমন, বিশ্ব, বা দেশ, বা রাজ্য, বা জেলা, বা গ্রাম, বা অন্ততঃপক্ষে পাড়া। নিজেকে বা নিজের আশপাশকে নিয়ে আমরা কিছু করতে পারি, যেমন উপার্জন করে সংসার চালানো, পড়ানো, ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, শেখানো, খাওয়া দাওয়া করা, থাকা, সুখদুঃখ শেয়ার করা ইত্যাদি। আশপাশ নিয়ে চিন্তা মানে আসলে সেগুলোর ভাবনা বা দুর্ভাবনা। ছোটোখাটো বা যাকে বলে সাংসারিক চিন্তা। চিন্তা তখনই স্বাধীন হয় যখন এসব আশেপাশের ভাবনা দুর্ভাবনাগুলো থেকে মুক্ত হয়ে মানুষের কথা ভাবতে পারা যায়। সেই চিন্তা মনুষ্যসমাজ জগৎ নিয়ে হতে পারে। মানুষের শরীর নিয়ে হতে পারে। মানুষের মন নিয়ে হতে পারে। পশু পাখী গাছপালা ইত্যাদি প্রাণীজগৎ নিয়ে হতে পারে। অথবা বস্তুজগৎ নিয়ে হতে পারে। এই সাংসারিক চিন্তা যাতে ওই মুক্ত চিন্তাকে বা মেটাফিজিক্যাল চিন্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করতে পারে সেই কারণে প্রাচীন দার্শনিকরা তো বিয়ে শাদিই করতেন না।

সেই কারণে মেটাফিজিক্যাল চিন্তা করতে গেলে নৈব্যক্তিক হতে হয় যা নিয়ে চিন্তা করা হচ্ছে তার থেকে। এমন একটা পরিসর নিয়ে চিন্তা করতে হয়, যেখানে আমি নেই। সমাজচিন্তায় চিন্তক সেই সমাজের কেউ নয়, পাখির চোখে সে দেখে সমাজকে। সেই সমাজচিন্তায় সমাজের একক হল ব্যক্তি মানুষ।

যতটা সহজে বলা হল, ততটা সহজে এই সমাজচিন্তাতেও একক হিসেবে ব্যক্তি মানুষ আসেনি। আমেরিকা ইউরোপে বহু সমাজচিন্তায় সমাজের একক হিসেবে থেকে গেছে সাদা চামড়ার মানুষরা। আমাদের দেশে সমাজচিন্তার একক হিসেবে সবাই সমান থাকেনি। ব্রাহ্মণদের মূল প্রাধান্য, তারপর ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্র — এইভাবে সমাজকে ভাগ করার সময় ব্যক্তির বদলে তার জাত পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সমাজের একক হয়েছে জাত পরিচয়। এই চারভাগের বাইরের মানুষকে নিয়ে ভাবাই হয়নি। শুদ্রকে ভাবা হয়েছে — যারা অন্য তিনভাগের সেবা করে, তারা। সমাজচিন্তায় ব্যক্তির একক হিসেবে চলে আসা তাই একটা বিরাট ব্যাপার।

প্রাচীন দর্শন-এ সমগ্রের ধারনাই ছিল মূল এবং ব্যক্তি ছিল সেই সমগ্রের অংশ, যার সমগ্রের অংশ হিসেবে ছাড়া আলাদা কোনও দাম ছিল না। ব্যক্তির কাজ ছিল সেই সমগ্রের চেতনা প্রাপ্ত হওয়া, তবেই তার চরম প্রাপ্তি। সমগ্রের সামঞ্জস্য ব্যক্তিকে তাড়া করত সবসময়। এছাড়া অন্যরকম দর্শনও ছিল, যাতে সমগ্রের ধারনার চেয়ে বেশি মূল্যবান ছিল ব্যক্তির হয়ে ওঠা। যখনই ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারত, তখন সে প্রকৃতির স্পর্শ পেত সরাসরি। সমগ্রের সামঞ্জস্য বা আশেপাশের টানাপোড়েন থেকে ঊর্ধে উঠতে পারত। মোট কথা ব্যক্তির ব্যক্তি হয়ে ওঠার ব্যাপার ছিল (যখন সে প্রকৃতির সাথে সরাসরি সংস্পর্শে আসবে, অনুভব করতে পারবে প্রকৃতিকে অন্য সমস্ত মধ্যস্থতা যেমন সমাজ বা বেচাকেনা ছাপিয়ে) অথবা সমগ্রের চেতনাপ্রাপ্ত (ভগবানের অনুভব জাতীয়) হয়ে ওঠার ব্যাপার ছিল।

মিশেল ফুকোর আর্কিওলজি অনুযায়ী মানুষ নিজেকে আবিষ্কার করল তার জ্ঞানের বিষয় এবং একইসাথে তার জ্ঞানের বিষয়ী হিসেবে –ঊনবিংশ শতকে। এতদিনে বোঝা গেল, আমাদের সম্পদের মূলে আছে আমাদেরই শ্রম। প্রাণীর মূলে আছে শরীরের ভেতরের গঠনতন্ত্রগুলি। ভাষার মূলে আছে শব্দের বদলে বদলে যাওয়া। দর্শনের অনিবার্যতার মধ্যে তার নিয়তি বাধা — এই বোধ অন্তর্হিত হল। বদলে এল — ও তো আমাদেরই কারো লেখা। আধুনিক চিন্তার ব্যাপারটাই হল নিজের মধ্যেকার অধিবিদ্যার আবেগকে সসীমতা দিয়ে আটকানো। জ্যান্ত মানুষ এল সমস্ত কিছুর কেন্দ্রে। মানুষ তার জীবনমৃত্যু দিয়ে বা শরীরস্বাস্থ্য দিয়ে, তার ভাষা দিয়ে বা প্রকাশ করার ক্ষমতা দিয়ে, তার নিজের শ্রম দিয়ে বা তার শ্রমের পরিমাণ দিয়ে সীমাবদ্ধ। কোন সময়কালের মানুষ সে তাই দিয়ে নির্ধারিত। কিন্তু সে জানল, তার সম্ভবনা অসীম। সে যে কী করতে পারে — তা ধারনার বাইরে বা চিন্তার অতীত। মানুষের নিজের এই জাগতিক অস্তিত্ব কিন্তু তুরীয় সম্ভবনাময় অস্তিত্ব ব্যক্তির ধারনার মধ্যে এক অদ্ভুত পটপরিবর্তন এনে ফেল্ল। বদলে গেল এতকালের জ্ঞানতত্ত্ব এবং দর্শন। অধিবিদ্যার পরাক্রমের বদলে এল — মানুষই অধিবিদ্যা বানায়। দর্শনের অনিবার্যতার বদলে এল — মানুষই দর্শনের বয়ান লেখে। সত্যির বদলে এল, সত্যি উৎপাদিত হয়। জ্ঞানের চেয়ে স্বাধীন এক অস্তিত্ব পেল মানুষ। আচ্ছা, এর মধ্যে দিয়ে কি ব্যক্তিমানুষ এক ধরনের জ্ঞান নিরপেক্ষ স্বাধীনতা পেল না? সমস্ত কিছুকে ছুঁড়ে ফেলার পরাক্রম পেল না?

ব্যক্তিমানুষের যে সমোজ্জ্বল ধারনা ফুকো নিয়ে এল (১৯৬০ এর দশকে) — তা দিয়ে বোঝা গেল — অন্য সমস্ত কিছু অস্তিত্বের থেকে ব্যক্তি মানুষকে উজ্জ্বলতম অস্তিত্ব হিসেবে দেখার মধ্যে দিয়ে, সময়ের কেন্দ্রে তাকে স্থাপন করার মধ্যে দিয়ে, তাকে অসীম সম্ভবনা হিসেবে অভিহিত করার মধ্যে দিয়ে ফুকো ব্যক্তিকে তার চিন্তার কেন্দ্রে স্থাপন করেছিলেন। ক্ষমতার প্রতিরোধী ব্যক্তিকে সামাজিক বিষয়ী হিসেবে স্থাপন করেছিলেন। বা বলা ভালো, ঐতিহাসিকভাবে ক্ষমতার প্রতিরোধী ব্যক্তি সামাজিক বিষয়ী হিসেবে বা ক্ষমতার বিষয় হিসেবে স্থাপিত হয়েছিল বলে বলেছিলেন।

ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি (১৮৪৫) মার্ক্স লিখেছিলেন, দার্শনিকরা জগৎকে ব্যাখ্যা করেন নানাভাবে, যদিও উদ্দেশ্য হল তার বদল ঘটানো। সেই লেখা তখন তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা কয়েকজন পড়েছিলেন হয়ত, আর কেউ পড়েনি। ফয়েরবাখের ওপর থিসিস প্রকাশ পেয়েছিল ঊনবিংশ শতকের একদম শেষদিকে, মার্ক্সের মৃত্যুর পর, লন্ডন থেকে, এঙ্গেলসের ফয়েরবাখের ওপর লেখা বই-এর সহায়ক পাঠ হিসেবে। যে লেখার মুখবন্ধ হিসেবে ফয়েরবাখের বস্তুবাদের ওপর এগারোটি থিসিস লিখেছিলেন মার্ক্স, সেই জার্মান ভাবাদর্শ প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৩২ সালে। ফুকো যখন ঊনবিংশ শতকের জ্ঞানতত্ত্বে বিশেষ বাঁক-এর কথা লিখছেন, তখন উনি ঊনবিংশ শতককে জ্ঞানের ইতিহাসের ছেদবিন্দু বলছেন যে জায়গা থেকে, মার্ক্সের দর্শন-এর পূর্বধারনা তার চেয়েও জঙ্গী ছিল নিঃসন্দেহে। মার্ক্স বস্তুতঃ বলতে চেয়েছিলেন, জ্ঞান আসলে বয়ান, যারা লিখছে তাদের বানানো ব্যাখ্যান, এবং বয়ান নির্মাণের উদ্দেশ্য থাকে, উদ্দেশ্য হল — যেগুলির বয়ান লেখা হচ্ছে, সেগুলির ভবিষ্যৎকে বদলানো, নিজেদের মনমতো করে গড়েপিঠে নেওয়া। ফুকো যখন লিখছেন (১৯৬০ এর দশক) সেই সময় অবশ্য নানাদিক থেকে এসব কথা উঠতে শুরু করে দিয়েছে (সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য : জঙ্গী নারীবাদের বয়ান)।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান